০৪:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“অপরাজেয়া: এক সাহসিনী আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি”

  • রিদম ডেস্ক:
  • Update Time : ০১:২৯:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫
  • ৫৭৪ Time View

"অপরাজেয়া: এক সাহসিনী আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি"

“অপরাজেয়া: এক সাহসিনী আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি”

প্রতিবেদক: জি কে রাকিব।

জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যারা সংগ্রামকে সঙ্গী করে এগিয়ে যান, তাঁদের গল্পগুলো হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তেমনই একজন সাহসিনী, স্বপ্নচারী এবং আত্মপ্রত্যয়ী নারীর নাম— রুমানা প্রধান । তার ডাকনাম রুনি
ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলায় দত্তের বাজার বারইগাঁও গ্রামের এক মুসলিম প্রধানিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই নারী। পিতা আবুল হোসেন পেশায় একজন কাঠের ব্যবসায়ী। মাতা নাসিমা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ বোনের মধ্যে রুমানা প্রধান মেজু। শৈশব কৈশোর ও যৌবন সমস্ত দাপতিক্রম করেছে নিজ গ্রামেই। প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাদ্রাসা থেকে। কন্যামন্ডল মা ফাতেমা দাখিল মাদ্রাসা থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণী থেকে দত্তের বাজার স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হন । তিনি মাধ্যমিক ২০১৫ এবং উচ্চ মাধ্যমিক ২০১৭ সালে পাস করেন। একই ধারাবাহিকতায়, গফরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তবে একাডেমীর সাফল্যের পেছনে ছিল অসংখ্য প্রতিকূলতা এবং বেদনাদায়ক বাস্তবতা। সপ্তম শ্রেণীতেই থাকাকালীন জীবনের কঠিন এক মুহূর্ত ঘুরে আসে-লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করতে হয় জীবিকার সংগ্রাম। কিন্তু হৃদয় ছিল অদম্য স্বপ্ন আর আস্থার দীপ্তি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরে তার ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার শিখা। নিজ বাজারে কম্পিউটার শিখতে যাওয়াতে মা তাকে অনেক মারে। মার খাওয়াতে তার জিত বেড়ে গেল যেভাবেই হোক আমি কম্পিউটার শিখবো। পরবর্তীতে ,২০১৯ সালে সবার আড়ালে একটি পত্রিকা দেখে আবেদন করেন গাজীপুর শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রশিক্ষনের জন্য নির্বাচিত হন। সবার চরম বাধা। মা বড় বোন কোনভাবেই শহরে আসতে দেবে না। যেদিন তার ইন্টারভিউ ছিল সেদিন মা দুই হাত রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। মা ভাবতো শহরে গেলে কেউ হয়তো বিক্রি করে দিবে। গ্রামের এক নানা এবং বড় বোনজামাই এর উৎসাহে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে কম্পিউটার কোর্স সম্পূর্ণ করেন। ২০২৩ সালের সাভার জাতীয় ইনস্টিটিউ ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গ্রাফিক ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া কোর্স ২৮ দিনের একটি কোর্সে আবেদন করেন সেখান থেকে ওয়েটিং লিস্ট থেকে তাকে ডাকা হয়। তখন আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। গফরগাঁও স্টেশন থেকে এয়ারপোর্ট আসতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে যায়। কোন উপায় না পেয়ে সারারাত স্টেশনেই কাটায়।পরের দিন সকালে ক্লাসে যেতেই যাদের কম্পিউটার ছিলনা তাদেরকে বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছে । মনে কষ্ট নিয়ে তিনি বাড়িতে চলে আসিনি বরং করছে একটা কম্পিউটার দেওয়ার জন্য দরখাস্ত ,সরকারি কম্পিউটার দেরিতে হাতে পাওয়াই কোর্স সফলভাবে করতে পারেনি।তারপর পুনরায় আবার এডমিশন নেন কিন্তু হাল ছাড়েননি রুমানা। ‘হোঁচট মানেই হার নয়’—এই বিশ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় সেশনে পুনরায় ভর্তি হন। দুঃখজনকভাবে, পুনরায় তাকে কোর্স থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই অপমানেও দমে যাননি তিনি। সকাল থাকে বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে ক্লাসরুমের সামনে বসে থাকার সাহসিকতা এবং আত্মবিশ্বাস দেখে প্রশিক্ষক বলেছিলেন— “জেদ যদি করতে হয়, এই মেয়েটির মতো করো— যে জেদ জীবনকে উন্নতি করে ।

এই মন্তব্য ছিল রুমানার জীবনের বাঁকবদলের অনুপ্রেরণা। সম্মানে তাকে ক্লাসে বসানো হয়। গ্রাফিক্স ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করে দক্ষতাকে আরও পাকাপোক্ত করেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেই তার মেধা ও নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ চাকরির অফার পান এবং যোগদান করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে। সেখান থেকে শুরু হয় তার নতুন জীবন, প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে থাকেন রুমানা প্রধান।

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় আইটি খাতে কাজ করছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেমিনার ও সভায় অংশগ্রহণ করে হয়ে উঠেছেন মূলধারার একজন সক্রিয় নারী। পাশাপাশি, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রুমানা প্রধান এখন শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, সমাজের অবহেলিত নারী সমাজের জন্যও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ব্রতী। রুমানা প্রধান কেবল একজন নারী নয়, একজন সৈনিক—যিনি জীবনযুদ্ধে সাহসিকতায়, ধৈর্য আর পরিশ্রমে এগিয়ে গেছেন। গ্রামের মাটির গন্ধে বড় হওয়া এই নারী আজ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে—প্রযুক্তি খাতের অন্যতম সফল নাম।

পরিশেষে, তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজের জন্মভূমির প্রতি জানিয়ে দিয়েছেন গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি, সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন যেন ভবিষ্যতেও তিনি একজন গর্বিত, দায়িত্বশীল ও প্রগতিশীল নারী হিসেবে সমাজকে আলোকিত করে যেতে পারেন।

Tag :
About Author Information

Popular Post

৩৬ দিনব্যাবী জুলাই বিপ্লব কর্মসূচি

“অপরাজেয়া: এক সাহসিনী আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি”

Update Time : ০১:২৯:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ মে ২০২৫

“অপরাজেয়া: এক সাহসিনী আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি”

প্রতিবেদক: জি কে রাকিব।

জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যারা সংগ্রামকে সঙ্গী করে এগিয়ে যান, তাঁদের গল্পগুলো হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তেমনই একজন সাহসিনী, স্বপ্নচারী এবং আত্মপ্রত্যয়ী নারীর নাম— রুমানা প্রধান । তার ডাকনাম রুনি
ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলায় দত্তের বাজার বারইগাঁও গ্রামের এক মুসলিম প্রধানিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই নারী। পিতা আবুল হোসেন পেশায় একজন কাঠের ব্যবসায়ী। মাতা নাসিমা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ বোনের মধ্যে রুমানা প্রধান মেজু। শৈশব কৈশোর ও যৌবন সমস্ত দাপতিক্রম করেছে নিজ গ্রামেই। প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় মাদ্রাসা থেকে। কন্যামন্ডল মা ফাতেমা দাখিল মাদ্রাসা থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণী থেকে দত্তের বাজার স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হন । তিনি মাধ্যমিক ২০১৫ এবং উচ্চ মাধ্যমিক ২০১৭ সালে পাস করেন। একই ধারাবাহিকতায়, গফরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তবে একাডেমীর সাফল্যের পেছনে ছিল অসংখ্য প্রতিকূলতা এবং বেদনাদায়ক বাস্তবতা। সপ্তম শ্রেণীতেই থাকাকালীন জীবনের কঠিন এক মুহূর্ত ঘুরে আসে-লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করতে হয় জীবিকার সংগ্রাম। কিন্তু হৃদয় ছিল অদম্য স্বপ্ন আর আস্থার দীপ্তি। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরে তার ইচ্ছা ছিল কম্পিউটার শিখা। নিজ বাজারে কম্পিউটার শিখতে যাওয়াতে মা তাকে অনেক মারে। মার খাওয়াতে তার জিত বেড়ে গেল যেভাবেই হোক আমি কম্পিউটার শিখবো। পরবর্তীতে ,২০১৯ সালে সবার আড়ালে একটি পত্রিকা দেখে আবেদন করেন গাজীপুর শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রশিক্ষনের জন্য নির্বাচিত হন। সবার চরম বাধা। মা বড় বোন কোনভাবেই শহরে আসতে দেবে না। যেদিন তার ইন্টারভিউ ছিল সেদিন মা দুই হাত রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। মা ভাবতো শহরে গেলে কেউ হয়তো বিক্রি করে দিবে। গ্রামের এক নানা এবং বড় বোনজামাই এর উৎসাহে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে কম্পিউটার কোর্স সম্পূর্ণ করেন। ২০২৩ সালের সাভার জাতীয় ইনস্টিটিউ ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় গ্রাফিক ডিজাইন এন্ড মাল্টিমিডিয়া কোর্স ২৮ দিনের একটি কোর্সে আবেদন করেন সেখান থেকে ওয়েটিং লিস্ট থেকে তাকে ডাকা হয়। তখন আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। গফরগাঁও স্টেশন থেকে এয়ারপোর্ট আসতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে যায়। কোন উপায় না পেয়ে সারারাত স্টেশনেই কাটায়।পরের দিন সকালে ক্লাসে যেতেই যাদের কম্পিউটার ছিলনা তাদেরকে বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছে । মনে কষ্ট নিয়ে তিনি বাড়িতে চলে আসিনি বরং করছে একটা কম্পিউটার দেওয়ার জন্য দরখাস্ত ,সরকারি কম্পিউটার দেরিতে হাতে পাওয়াই কোর্স সফলভাবে করতে পারেনি।তারপর পুনরায় আবার এডমিশন নেন কিন্তু হাল ছাড়েননি রুমানা। ‘হোঁচট মানেই হার নয়’—এই বিশ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় সেশনে পুনরায় ভর্তি হন। দুঃখজনকভাবে, পুনরায় তাকে কোর্স থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই অপমানেও দমে যাননি তিনি। সকাল থাকে বিকেল পর্যন্ত না খেয়ে ক্লাসরুমের সামনে বসে থাকার সাহসিকতা এবং আত্মবিশ্বাস দেখে প্রশিক্ষক বলেছিলেন— “জেদ যদি করতে হয়, এই মেয়েটির মতো করো— যে জেদ জীবনকে উন্নতি করে ।

এই মন্তব্য ছিল রুমানার জীবনের বাঁকবদলের অনুপ্রেরণা। সম্মানে তাকে ক্লাসে বসানো হয়। গ্রাফিক্স ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করে দক্ষতাকে আরও পাকাপোক্ত করেন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেই তার মেধা ও নিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ চাকরির অফার পান এবং যোগদান করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলে। সেখান থেকে শুরু হয় তার নতুন জীবন, প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে থাকেন রুমানা প্রধান।

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় আইটি খাতে কাজ করছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেমিনার ও সভায় অংশগ্রহণ করে হয়ে উঠেছেন মূলধারার একজন সক্রিয় নারী। পাশাপাশি, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রুমানা প্রধান এখন শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, সমাজের অবহেলিত নারী সমাজের জন্যও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ব্রতী। রুমানা প্রধান কেবল একজন নারী নয়, একজন সৈনিক—যিনি জীবনযুদ্ধে সাহসিকতায়, ধৈর্য আর পরিশ্রমে এগিয়ে গেছেন। গ্রামের মাটির গন্ধে বড় হওয়া এই নারী আজ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে—প্রযুক্তি খাতের অন্যতম সফল নাম।

পরিশেষে, তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজের জন্মভূমির প্রতি জানিয়ে দিয়েছেন গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি, সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন যেন ভবিষ্যতেও তিনি একজন গর্বিত, দায়িত্বশীল ও প্রগতিশীল নারী হিসেবে সমাজকে আলোকিত করে যেতে পারেন।